অণুগল্প

এটি নিছকই রুপকথার গল্প নয় : অভিজিৎ কুমার দাশ

একদা এক রাজার ছিল তিন কন্যা; এর মধ্যে মেজ রাজকন্যা ছিল যেমন রূপবতী, তেমনি গুণবতী। রূপে-গুণে অন্য দুই রাজকন্যার সাথে মেজ রাজকন্যার এতোটাই পার্থক্য ছিল যে তাঁরাও মেজ রাজকন্যাকে ‘শ্রেয় বোন’ আর ‘শ্রেয় দি’ বলেই ডাকতো। অন্য দুই রাজকন্যাও যেন মেনে নিয়েছিল তারা হচ্ছে যেমন-তেমন! অর্থাৎ মেজ রাজকন্যাকে প্রতিযোগিতাহীন শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি প্রদান করেছিল তারা।

যৌবনের প্রারম্ভে পাশ্ববর্তী রাজ্যের সৌম্যদর্শন এক রাজপুত্রের সাথে সাক্ষাৎ হলো মেজ রাজকন্যার। এরপর তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক। এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল; তবে রাজকন্যা কখনো জানতে পারেনি রাজপুত্র জ্ঞান গরিমায় অসাধারণ হলেও যুদ্ধবিদ্যায় তার কোন কোন আগ্রহ নেই। রাজপুত্র ছিল অত্যন্ত নরম মনের অন্তর্মূখী এক মানুষ। কিভাবে জানবে? রাজকন্যা নিজের কথা শোনাতে শোনাতেই যে অভিসারের সময় শেষ করে ফেলতো!

অন্যদিকে অতি-প্রশংসা আর অতি-আত্মবিশ্বাসের জেরে রাজকন্যা এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হলো; রোগটি হলো `Disease of me’; ‘আমিত্ব রোগ’। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ নিজেকে ছাড়া আর কাউকে গ্রাহ্য করে না; নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করে এবং শুধুমাত্র নিজেকেই সেরা মনে করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। এতে আত্মসচেতনতা (Concern) পরিবর্তিত হয়ে ঘোর (Obsession)-এ আর আত্মবিশ্বাস (Confidence) পরিবর্তিত হয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ (Arrogance)-এ পরিণত হয়। ফলে দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

একদিন রাজপুত্র একটি দুর্ঘটনার জন্য তাদের অভিসারের স্থানে উপস্থিত হতে ব্যার্থ হয়। রাজকন্যা উদ্বিগ্ন হবে ভেবে রাজপুত্র দুর্ঘটনার সংবাদ প্রদান করা থেকেও বিরত থাকে। কিন্তু রাজকন্যা ভাবলো রাজপুত্র তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ভাবনা থেকেই রাজকন্যার আমিত্ব রোগ আরো তীব্র আকার ধারণ করলো; বিষয়টি তার অহং-এ এতটাই আঘাত করলো যে রাজকন্যা তার দূতের মাধ্যমে এই বলে সংবাদ প্রেরণ করলো যে এরপর সামনে পেলেই সে রাজপুত্রকে হত্যা করবে!

অন্তমুর্খি অভিমানী রাজপুত্র এ সংবাদে এতটাই আঘাত পেয়েছিল যে সত্যিই আর কখনো রাজকন্যার সামনে উপস্থিত হয়নি রাজপুত্র। আর কোন দিন দেখা হয়নি রাজকন্যা-রাজপুত্রের। রাজপুত্রের ব্যাখ্যা ছিল “আমার অস্তিত্ব যার নিকট অসহ্য তাকে আমি যতই ভালোবাসি না কেন, সম্পর্ক থাকে কেমন করে!” আর রাজকন্যার ব্যাখ্যা ছিল “আমি তো কোন দোষ করিনি, রাজপুত্র আমাকে গুরুত্ব দেয়নি, আমার নিকট সে ক্ষমা প্রার্থনাও করেনি।” রাজকন্যা-রাজপুত্রের অহং (Ego) এর জন্য তাদের প্রেম শত্রুতায় পরিণত হলো। আর সেই থেকেই বন্ধু রাজ্য দুটিও একে অপরের শত্রু।

এটি নিছকই একটি গল্প ছিল, তবে গল্পটি বাস্তবতা বিবর্জিত নয়। অহং কেবলমাত্র সুন্দর সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, কর্মক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অহং থেকেই জন্ম নেয় আত্ম-অহংকার, হিংসা আর আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব। তাই অহং পরিহার করা আবশ্যক; কিন্তু অহং পরিহার করার জন্য আমরা কি করতে পারি? আমরা একটি পদ্ধতির আশ্রয় নিতে পারি; পদ্ধতিটি ‘প্লাস, মাইনাস, ইকুয়াল (+, -, = ) পদ্ধতি’ হিসেবে পরিচিত।

‘প্লাস’ হচ্ছে এমন কেউ যে জ্ঞান, গরিমায় আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, যাকে আমি গুরু মানতে পারি; ‘মাইনাস’ হচ্ছে এমন কেউ যে জ্ঞান, গরিমায় আমার চেয়ে কম, যাকে শেখানো যায়; ‘ইকুয়াল’ হচ্ছে এমন কেউ যে আমার মতো, যার সাথে আমি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পারি।

যখন আমারা কোন কিছু অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করি তখন অহং থেকে মুক্তির জন্য কিছু ‘ইকুয়াল’ এর সান্নিধ্য প্রয়োজন; এতে নিজের অবস্থান যাচাই করা যায়।

যখন আমরা কোন কিছু অর্জনে সফল হই তখন অতি আত্মবিশ্বাস জনিত অহং থেকে মুক্তির জন্য এমন কারো সান্নিধ্য প্রয়োজন যে আমাদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি সফল; এতে বোঝা যায় আসলে আমরা কত ক্ষুদ্র!

আর যখন আমারা কোন কিছু অর্জন করতে ব্যার্থ হয় তখনো আমাদের নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা জনিত অহং বজায় থাকে; তখন আমরা অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে থাকি। এই অহং থেকে মুক্তির জন্য আমাদের কিছু ‘মাইনাস’ প্রয়োজন যাদের শেখানোর মাধ্যমে আমরা নিজের শেখার ত্রুটি যাচাই করতে পারি।

প্রতিনিয়ত আমি এত এত ‘প্লাস, মাইনাস, ইকুয়াল’ এর সান্নিধ্য লাভ করি; সত্যিই নিজেকে এখন গল্পের রাজকন্যা-রাজপুত্রের চেয়ে ভাগ্যবান মনে হয়!

লেখক: উপ-ব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ।