০৯ অক্টোবর ২০১৯
.‘হে রাব্বুল আলামিন, তোমার কাছে বিচার চাই’—পুত্রহারা মাকে বিলাপ করতে শুনলাম টিভি চ্যানেলের সংবাদে। মানুষের পৃথিবী যদি ন্যায়বিচার করল তো করল, না করার সম্ভাবনা নেই, তা নয়; তাই সেই মহাশক্তির কাছে ফরিয়াদ।
আমার দীর্ঘকালের বন্ধু আবুল কাসেম ফজলুল হকও তাঁর পুত্র দীপনের হত্যাকাণ্ডের পর মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না।’ বিচার চাইলেও সে বিচার কবে শেষ হবে এবং বিচারের রায় কবে কার্যকর হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল না। হত্যা করা হয়েছে তাঁর স্বাধীন চিন্তার কারণে। বাংলাদেশ-ভারতের সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস তাঁর হত্যার কারণ বলে এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে পিটিয়ে। পুলিশ অকুস্থল থেকে উদ্ধার করেছে রক্তমাখা স্টাম্প ও লাঠি।
বুয়েট একটি অহংকারের নাম। দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটা অংশই বুয়েটে ভর্তি হয়ে থাকেন। আততায়ীরা আবরারকে সন্দেহ করেছিলেন তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন সমর্থক। খবরে জানা গেল, নিয়মিতই শিবির সন্দেহে বুয়েটে মারধর করা হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। সংগঠন হিসেবে শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, এমন কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত নেই। তা ছাড়া, আবরার শিবির কর্মী, সে প্রমাণও দুই দিনে পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, তাঁর দাদার সময় থেকেই তাঁদের পরিবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। আবরার ও তাঁর পরিবার কোন দলের সমর্থক, তার চেয়ে বড় কথা তাঁরা নিজের দেশটাকে ভালোবাসেন। যদিও দেশকে ভালোবাসা এখন আর কারও গুণ নয়—ক্ষেত্রবিশেষে কঠিন অপরাধ।
আবরারকে কেউ না কেউ নিজের হাতে পিটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আততায়ী কোনো ব্যক্তি নন, একটি গোত্র। একটি প্রতিষ্ঠানের নেতা-কর্মীদের দ্বারা গঠিত সেই গোত্র। আবরার হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে পুলিশ যাঁদের চিহ্নিত করেছে, তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। ছাত্রলীগ যে শুধু ভিন্নমতের সমর্থকদের হত্যা করে তা নয়, প্রয়োজনে তারা নিজের সংগঠনের বন্ধুদেরও হত্যা করে। ‘২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হন ৩৯ জন। আর এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারান অন্য সংগঠনের ১৫ জন।’ (প্রথম আলো, ৮ অক্টোবর ২০১৯) বলা বাহুল্য, গত পাঁচ বছর তারা শান্তভাবে বসে ছিল। এ সময়েও তাদের হাতে হতাহতের সংখ্যা সামান্য নয়।
কিছু কিছু মৃত্যুর একধরনের সান্ত্বনা থাকে। কারণ, সেসব মৃত্যু তাঁদের মহিমান্বিত করে। সে রকম মৃত্যুতে তাঁদের প্রিয়জনদের অপার অহংকার। রফিক, বরকতের মায়ের সান্ত্বনা, তাঁদের পুত্র জাতীয় ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দান করেছেন। আসাদের মায়ের সান্ত্বনা, তাঁর ছেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন। নূর হোসেনের মায়ের অহংকার, তাঁর ছেলে স্বৈরশাসকের রাইফেলের সামনে বুক পেতে দিয়েছেন। ডাক্তার মিলনের মায়ের সান্ত্বনা, স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। দরিদ্র দরজি বিশ্বজিৎ দাসের মায়ের সান্ত্বনা কী? তাঁর ছেলে কেন ছাত্রলীগ নেতাদের চাপাতির কোপে নিহত হবেন? আবরারের মায়ের বুক যে খালি হলো, তার সান্ত্বনা কোথায়? তাঁর ছেলে তো কোনো অন্যায় করেননি, অপরাধ করেননি, কাউকে আঘাত করেননি, কোনো রাজনীতিতে ছিলেন না। তিনি যা বিশ্বাস করেছেন, তা ব্যক্ত করেছেন মাত্র।
সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কার্যকর সংসদ থাকলে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পার্লামেন্টেই আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হতো। তখন কোনো বাচ্চা ছেলেকে দেশের স্বার্থ নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য না করলেও হতো। দেশের স্বনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চুপ বলেই দেশপ্রেমিক ছেলেমেয়েদের কলম ধরতে হয়। যে কাজ দেশের পাকাচুল বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদদের করার কথা, সে দায়িত্ব পালন করছে ১৫-২০ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা। বিপদগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা নিয়েই তারা তা করছে। আবরারদের মতো বিবেকবান ছেলেমেয়েদের হত্যা করা যায়, তাঁদের স্বাধীন চিন্তার মৃত্যু নেই। ভিন্নমতাবলম্বী অথবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করা আদিম বর্বর যুগের উপজাতীয় বৈশিষ্ট্য। মানুষ অরণ্যজীবন থেকে সভ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আদিম অভ্যাসকে ঘৃণা করতে শিখেছে। আমরা আজ সেই আদিম অসভ্যতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেছি।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আমরা জানতাম স্বাধীন চিন্তার ল্যাবরেটরি, স্বাধীন মতপ্রকাশে সেখানে কাউকে বাধা দেওয়ার কথা নয়। শক্ত যুক্তি দিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে, দৈহিক উত্তেজনা প্রকাশের প্রয়োজন নেই। সমাজে যদি প্রতিবাদী কণ্ঠই না থাকল, তাহলে তো সে সমাজ বন্ধ্যা বা মৃত। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতিও থাকবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দেশের রাজনীতি নিয়ে একাডেমিক বিচার-বিশ্লেষণ করবেন। রাজনীতিবিদদের পথনির্দেশ করবেন, তবে সরকারি দলের বা বিরোধী দলের দাসত্ব সমর্থনযোগ্য নয়। ঠিকাদারদের থেকে কমিশন নেওয়া, চাঁদাবাজি, গুন্ডামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ত্রিসীমানায় থাকবে কেন?
আবরারের হত্যাকাণ্ডের খবর শোনার পর আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, এই বর্বরতা ঘটত না যদি দুই সপ্তাহ আগে আরেকটি ঘটনা না ঘটত। ২৩ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অতর্কিত হামলা করেন। অভ্যাস থাকলে আক্রমণ করতেই পারেন। হাত-পা ভেঙে দিতে পারেন। কিন্তু সেই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যে ভূমিকা দেখা গেল, তাতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ নেতাদের আরও বেশি বেপরোয়া হওয়ার সাহস সঞ্চারিত হয়। ওই ঘটনার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যদি ছাত্রলীগের নেতাদের ডেকে ধমকে দিতেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীর প্রাণ যেত না। অপারেশন শুরুর আগে আবরারের হত্যাকারীদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, এ কাজে তিরস্কার নয়, সরকারি দলের নেতাদের ধন্যবাদ পাবেন। সাধারণ ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে না উঠলে তাঁরা কী পেতেন, তা বলাও যায় না। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক যে কতবার মার খেলেন, জখম হয়ে হাসপাতালে গেলেন, অথচ সরকারি দলের কেউ তার নিন্দা করলেন না।
ছাত্রসংগঠনের কিছু কিছু গর্হিত কাজে সরকার সাময়িকভাবে লাভবান হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার ও সরকারি দলের ক্ষতিই বেশি। দলের ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়। দল ক্ষমতায় টিকে থাকে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মন থেকে মুছে যায়। তার চেয়ে বড় ক্ষতি একটি দলের জন্য আর কী হতে পারে!
আবরার চলে গেছেন। তাঁর সম্পর্কে আমার বলার কিছু নেই। তাঁকে চিনতামও না। বেঁচে থাকলে হয়তো কোনো বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী হয়ে অবসর নিতেন। শিক্ষকতা গ্রহণ করলে উপাচার্যও হতে পারতেন। অথবা নিজেই একটা সফল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেন। শুধু তাঁর মা-বাবার বুক খালি নয়, দেশের বুক থেকে একজন মেধাবী সন্তান মহাকালের গহ্বরে ছিটকে পড়লেন। একটি মেধা থেকে বঞ্চিত হলো জাতি।
সবশেষে বলতে চাই, শুধু আবরারের জন্য নয়, আমার দুঃখ হচ্ছে তাঁর হত্যাকারীদের জন্যও। তাঁরা কেউ নিশ্চয়ই খুনি পরিবারের সন্তান নন। তাঁরা কেউ খুনি হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। তাঁরাও আবরারের মতো মেধাবী। তাঁদের মা-বাবারও অনেক স্বপ্ন ছিল। তাঁরা তাঁদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে সুযোগ্য মানুষ হতে বুয়েটে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের থেকে সুশিক্ষা পাননি, শিক্ষা পেয়েছেন ক্ষমতার অজ্ঞাত স্থান থেকে। তাঁরা হয়তো আর ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবেন না। তাঁদের পরিচয় তাঁরা ফৌজদারি অপরাধী—ক্রিমিনাল। তাঁরা ক্রিমিনাল ছিলেন না, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাঁদের ক্রিমিনাল বানিয়েছে। সুতরাং, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আমরা কার বিচার করব? হত্যাকাণ্ডটি উপসর্গমাত্র—রোগটি কঠিন।
আপনার মন্তব্য লিখুন