অণুগল্প

অনুগল্প

মোসাদ্দেক আহমেদঃ
গরঠিকানি বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে। পাশের সিগারেট কোম্পানি কিনেছে। একরকম জোর করেই। আমার মতো অনেকের বসতবাড়ি কিনে নিয়েছে, কারখানার এক্সটেনশন হবে। চলে যাওয়ার মুহূর্তে শেষবারের মতো তাকালাম। আধাপাকা এল-প্যান্টার্ন বাড়ির পেছনে তালগাছের শাখে বাবুই পাখির বাসা বাতাসে দুলছে। দোল খাচ্ছে বাবুই পাখিগুলোও। বাবুই পাখিগুলো এখনও তাদের বাস্তুচ্যুতির সংবাদ জানে না।
সেলিব্রিটি
সেলিব্রিটি কামালউদ্দীনের তৃতীয় স্মরণসভা চলছে। দুটো টিভি চ্যানেল লাইভ কাভারেজ দেখাচ্ছে। মাইকের সামনে একে একে বিজ্ঞ আলোচকরা, নানাদিকে আলোকপাত করছেন। কামালউদ্দীনের বিপুল সৃষ্টিকর্ম নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হতে সমবেত শ্রোতামণ্ডলী অভিভূত। স্মরণে, শ্রদ্ধায়, আলোচনায় ঘণ্টাদুয়েক কখন কাবার। এবার সভাপতির শেষ বক্তব্য, সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শোকসভার সমাপ্তি টানার পালা, একটু ব্যত্যয় ঘটিয়ে তিনি সামনের সারিতে উপবিষ্ট কামালউদ্দীনের শোকসন্তপ্ত স্ত্রী জেসমিনের দিকে তাকালেন, একটি-দুটো কথা বলতে সকাতর অনুরোধ জানালেন। মৌনী জেসমিন কিছু বললেন না।
বাড়িতে ফিরে দেয়ালে ঝোলানো স্বামীর ছবির দিকে চোখ যেতে জেসমিনের মৌনতা খসে পড়ল; শোকের আস্তর ও চোয়াল শক্ত, ‘কিছু বলিনি, বললে তোমার মুখ থাকত!’
বিভ্রম
বিছানার প্রিন্টেড চাদরে প্রচুর পোকামাকড়ের ছবি। ওই চাদর পাতলেই জবর কাণ্ড, ফজল আলী রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন, রাজ্যের বিষধর পোকাগুলোর টার্গেট হয়ে যান, পোকা সব গায়ে কিলবিল করে। তবে ধড়মড়িয়ে জেগে উঠেই তিনি বুঝতে পারেন- ভয়ের কিছু নেই, স্রেফ দুঃস্বপ্ন। এমনই চলছিল এতকাল। সেদিন ঘুমের ভেতর বিকটদর্শন পোকারা সজোরে কামড়ে দেয়। এবার জেগে ওঠার পর আর দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে না। কব্জির কাছে হাত জ্বালা করছে, আর বিষম লালও হয়ে আছে। ঠিক কোন পোকা কামড়েছে, কিছুই বুঝতে পারছেন না।
ফোরম্যান
রাজু অটোরাইস মিলের ফোরম্যান। রোজ ছুটির পর সোজা বেরিয়ে এসে মিলের ঝকঝকে মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায়। ছুটি করে চম্পার কাছে যাওয়ার আগে এমনই রোজ চুল পরিপাটি করে। গত ক’দিন রাজু তেমন করছে না। ক’দিন আগে জোর বাঁচা বেঁচে গেছে চম্পা, অবশ্য চুলোর আগুনে মাথার চুলগুলো পুড়ে ঝলসে গেছে। বিধবাদের মতো দেখতে ন্যাড়ামাথার চম্পার সামনে দাঁড়ালে রাজুর এখন নিজের একমাথা ঝাঁকড়া চুল বাহুল্য মনে হয় আর ওই ঝাঁ চকচকে মেইন গেটটাকেও।
কথোপকথন
-আরে দোস্ত, তুই! ভালো তো?
-তা ভালোই।
মেলাদিন বাদে দেখা।
-হ্যাঁ, কতদিন পর। এখন আমি জেলখানার পেছনে থাকি।
-সেও ভালো, জেলখানার ভেতর থাকতে হয় না।
-যা বলেছিস দোস্ত। জেলখানার জানালা দিয়ে একফালি জ্যোৎস্না আর ক’টা তারা বই কী বা দেখা যায় বল।
বৈপরীত্য
লোকটা একটা অচেনা মহল্লার রাস্তা ধরে হাঁটছে। একসময় একটা টিনের জরাজীর্ণ বাড়ি চোখে পড়ল যার রংচটা টিনের গেটে লাল কালিতে লেখা- জসিম ম্যানশন। লোকটা হাসল।
কিছু দূর এগোতে একটা আলিশান হাইরাইজ বিল্ডিং দেখতে পেল। এসএস শিটের উজ্জ্বল গেটের মাথায় পিতলের অক্ষরে ঝলকাচ্ছে বাড়ির নাম- কুটির। লোকটা এবারও হাসল।
বিড়াল
বিড়ালটা বেশ জ্বালায়। ফাঁক পেলেই সিঁড়ি কী বারান্দাঘেঁষা পাইপ বেয়ে ঘরে ঢোকে। খাবার তছনছ করে। কিন্তু আজ লিমিট ছাড়িয়ে গেছে। তাড়িয়ে দিলেও ফিরে ফিরে আসছে। খোলা জানালা দিয়ে ফের ঢুকল। তহমিনা স্বামীকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন। ঘড়ি ধরে আফজাল সাহেবকে খাবার দিতে হয়। ইনসুলিন নেয়ার আধঘণ্টার মধ্যে খাবার দিতেই হয়। ডাইনিংয়ে ঢুকে পড়া বিড়ালের দিকে তাকিয়ে মেজাজ খিঁচরে গেল, হুংকার দিতে যেয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন, ‘না, বড্ড বিরক্ত করছে। বিড়ালটার আজ হল কী? ঠিক খাওয়া জোটেনি। দাঁড়া, আগে তোকেই খেতে দিই।’
ডাইনিং টেবিলে বসে আফজাল সাহেব স্ত্রীর কাণ্ড দেখছিলেন। একটু অবাকও। বিড়াল তহমিনার দু’চোখের বিষ; কিন্তু সিঁড়ির গোড়ায় বোনপ্লেটে এঁটোকাঁটা ঢেলে দেয়ার সময় তাকে অপ্রসন্ন দেখাল না। ক্ষুধার্ত বিড়াল চেটেপুটে সব খেয়ে নিল। এরপর দুদিন বিড়ালটার দেখা নেই। খুব খিদে পেলেই তবে আসে। আগের মতো জ্বালাতনও করে না। এর চেয়ে তাদের মেজো জামাইটাই বরং বেশি জ্বালাচ্ছে!
শিশুশিক্ষা
বিকেল হলেই মায়ের ডাক, তানিয়া বর্ণমালা পড়তে বসে। মায়ের চোখে অনেক স্বপ্ন, টানা পড়িয়ে যান; কিন্তু রাত নটা নাগাদ তানিয়ার চোখ ঢুলুঢুলু, যেন ঘুম যাবে বইয়ের ওপর। বাবার মায়া হয়, অনুনয় করেন, ‘অনেক হয়েছে, আর কত।’
মায়ের হুঁশ ফেরে, সস্নেহে মেয়েকে কোলে তুলে আদর করেন। কিন্তু পরদিন পড়াতে বসলে একই গল্প, মায়ের চোখে স্বপ্ন নামে, রাত অব্দি পড়ান। আবারও বাবার অনুনয়বিনয়-‘আহা, অতটুকুন মেয়ে…।’ মেয়ে সেদিনকার মতো ছুটি পায়, মায়ের আদরও।
ক’দিন বাদে বাড়িতে গৃহশিক্ষক এলেন। গৃহশিক্ষকের চোখেও সেই দিগন্তজোড়া স্বপ্ন। পড়তে পড়তে তানিয়া এবার হাই তোলে।
চার বন্ধু
ওরা চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুটো সোফায় চারজন মুখোমুখি বসে। সবার মুখ অর্ধনমিত, চ্যাটিংয়ে এমন মজে আছে যে, উপস্থিত কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না।
বাবা
আতর আলী মহল্লার রিকশা-ভ্যান চালক। মাসদেড়েক হল সন্ধ্যার পর ভাড়া খাটে না। অসুস্থ মেয়েকে রিকশা-ভ্যানে চড়িয়ে মহল্লার রাস্তা ধরে ঘণ্টাদুয়েক টহল মারে। ডাক্তার স্পষ্ট বলেই দিয়েছেন কিডনি নষ্ট, আশা নেই। আত্মীয়স্বজন কবিরাজের কাছে নিতে বলেছিল, কেউ বা পীরের দরগায়। আতর আলী রাজি হয়নি। যতক্ষণ রিকশা-ভ্যানে তুলে ঘোরায়, ততক্ষণ ক্লাস ফাইভে পড়া মুমূর্ষু মেয়েটি বরং চুপচাপ, অসুখে কাতরায় না। খোলা বাতাস কেটে রিকশা-ভ্যান চলে। তেল চিটচিটে কাঁথা গায়ে নিস্তেজ পড়ে রয়েছে মেয়েটি। ঝিরিঝিরি বাতাস মেয়েটির চুলে বিলি কেটে যায়। হঠাৎ কচি মাথা তুলে মেয়েটি দেখল বাবাকে, ‘বাজান, তুমি দম নেও। ঘামে নায়ে উঠিছ। এট্টু দম নেও।’
ঝিমিয়ে পড়া আতর আলীর পায়ে ঝিলিক খেলে যায়। তামামদিন বাদে মেয়ের মুখে বোল ফুটেছে। আবার দেখো, খবরদারির তেজও মেয়ের গলায়, অসুখ ধরা পড়ার আগে যেমন বলত। চোখ দুটো জলে ঝাপসা হচ্ছে দেখে আতর আলী ফাঁপরে পড়ে। ঝাপসা চোখে প্যাডেল মারতে নেই।
ঘোষণা
রহমতুল্লাহ নিয়মিত স্পিচ থেরাপি করেন। তার গলার সমস্যা, ভোকাল কর্ড মোটা হয়ে গেছে। ফলে গলার ব্যায়াম করতেই হয়। হাতেগোনা কয়েকটি ব্যায়াম। এ যেমন- এক, দুই, তিন থেকে দশ পর্যন্ত গোনা, আবার সুনির্দিষ্ট ধ্বনির মতো আওয়াজ তুলে জিবের ডগা গলার ভেতরে ঠেলে দেয়া, এসব আরকি। আরও একটি ব্যায়াম আছে; তখন বলতে হয়- আই অ্যাম জর্জ বুশ। প্রতিদিন তিনবার করতে হয়। সাউন্ডবক্স ভালো থাকে।
রহমতুল্লাহকে দেখে দেখে সাড়ে পাঁচ বছরের নাতি সৌহার্দ্যও ব্যায়ামগুলো দিব্যি শিখে গেছে। দিনের মধ্যে কতবার যে সৌহার্দ্য এসব বলে তার ঠিকঠিকানা নেই। বাড়ির সবাই উপভোগ করে। সেদিনও সৌহার্দ্য ব্যায়ামগুলো উচ্চারণ করছিল। বেশ হচ্ছে। গণনার ব্যায়াম, ধ্বনিপুঞ্জের ব্যায়াম পর্যন্ত ঠিকঠাক; কিন্তু আই অ্যাম জর্জ বুশের বেলায় গিয়েই বিপত্তি, নাতি-ছেলে ‘আই অ্যাম …’ বলে বারবার থেমে যাচ্ছে।
‘কী হল দাদুভাই, নির্ঘাত ভুলে গেছ? কোনো ব্যাপার না। এ শিখিয়ে দিচ্ছি। বল আই অ্যাম জর্জ বুশ।’
‘আমি জর্জ বুশ বলব না।’
গরম ভাতের গল্প
প্রায় প্রতিসন্ধ্যায় বুড়ো ফকিরটা মহল্লার বড় ড্রেনের এ জায়গায় এসে দাঁড়ায়। রাস্তার ওপারের অটোরাইস মিলের পাইপটা এসে মিশেছে এখানে। সন্ধ্যার দিকেই অটোরাইস মিলের গরম পানি গলগলিয়ে ঢোকে প্রশস্ত ড্রেনে। ঘণ্টাদেড়েকের মতো ফুটন্ত পানি ছাড়ে। রীতিমতো ড্রেনজুড়ে গরম ভাতের ভাপ ওঠে। যেন ড্রেনটাই মস্ত ভাতের হাঁড়ি!