( ১৯৭১ সালে ঢাকাতে যে কয়েকজন যোদ্ধাদের নাম শুনলে পাকি ও তার দোসরা প্যান্ট নষ্ট করে ফেলতো তাদের একজন – গুলিস্তানের গ্যানিস সুপার মার্কেট একাই উড়িয়ে দিয়েছিলেন তার নাম হচ্ছে – সাদেক হোসেন খোকা – আসুন তার মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনি )
মেজর হায়দারের অধীনে তিন সপ্তাহ গেরিলা ট্রেনিং শেষে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ক্যাপ্টেন গাফফারের (পরে জাতীয় পার্টি নেতা) নেতৃত্বাধীন সাব সেক্টরে পাঠানো হয়। আমরা গভীর রাতে সেখানে গিয়ে পৌঁছাই। এখানে দুই সপ্তাহ ট্রেনিংয়ের প্রথমদিন সকালে তিনি আমাদের ৪০ জনকে ২০ জন করে দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যেতে বললেন। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই দুটি গ্রুপ হতে পারছিলাম না। তখন তিনি নির্দেশ দিলেন ফলইন করার (এক লাইনে দাঁড়ানো)। আমি আর আমার বন্ধু জাকির দাঁড়ালাম পরপর যাতে এক গ্রুপে থাকতে পারি। কিন্তু তিনি নির্দেশ দিলেন প্রথম থেকে বিজোড় (১,৩,৫) এক গ্রুপে, জোড় (২,৪,৬) আরেক গ্রুপে। ফলে আমাদের মতো অনেকেই যারা একসঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন পড়ে যাই ভিন্ন গ্রুপে। আমাদের মন খারাপ হয়েছে লক্ষ্য করে প্রাণবন্ত ক্যাপ্টেন গাফফার বললেন, ‘তোমরা দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করতে এসেছো, এখানে মান-অভিমান-আবেগের কোনো মূল্য নেই।’ তোমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড যার যতোই ভালো হোক না কেন, সবাই এখানে সাধারণ সৈনিক।
ওখানে ট্রেনিং শেষ করার পর প্রথমদিকে কসবা-মন্দভাগ (মির্জাপুর) বর্ডার এলাকার সাব সেক্টরে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। এসব যুদ্ধে ক্যাপ্টেন গাফফার সরাসরি অংশ নিতেন এবং শত্রুর বাঙ্কারের কাছাকাছি তিনি চলে যেতেন। তার সাহসিকতা দেখে আমরা দারুণ অনুপ্রাণিত হই। এখানে যুদ্ধ করেই মূলত এসএমজি, এসএলার ও চাইনিজ রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র পরিচালনা ও সরাসরি যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করি। ওখানেই একটি যুদ্ধে প্রবল সাহসিকতা দেখিয়ে শহীদ হন গোপীবাগ এলাকার কৃতীসন্তান ও আমার ঘনিষ্ঠবন্ধু জাকির হোসেন।
ট্রেনিং শেষে আমাকে একটি গেরিলা গ্রুপের কমান্ডার করে ঢাকায় পাঠানো হয়। এ গ্রুপে আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা যোদ্ধা ছিল ৪০ জন এবং এখানে এসে আরো ২৫ জন রিক্রুট করি। ঢাকায় আসার আগেরদিন মেজর হায়দার গেরিলা যুদ্ধ এবং শক্র এলাকায় অবস্থানকালে কী কী বিষয় অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে সে বিষয়ে একটা ব্রিফিং দেন। স্লিপিং গাউন পরা মেজর হায়দার মোহনীয় ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছিলেন; যা আজো আমার স্মৃতিতে একটা জীবন্ত ঘটনা হিসেবে জায়গা করে আছে। তখন ঢাকার আয়তন এবং জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। আর পাকবাহিনীর দখলদারিত্বের কারণে এ শহরের বহু লোক নিরাপত্তার অভাবে গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন, ফলে ঢাকা প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের আগেও কয়েকটি গ্রুপকে গেরিলা অপারেশনের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ অসাবধানতার জন্য পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়েছিলেন। অপারেশন শুরু করার আগে আমরা অগ্রবর্তী গ্রুপগুলোর ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করি। আমার সঙ্গী যারা ছিলেন জনপ্রিয় পপ গায়ক আজম খান, ইকবাল সুফী, আলমাস লস্কর, কাজী মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ (বর্তমানে ব্যাংক কর্মকর্তা), মোহাম্মদ শফি, খুরশিদ, আব্দুল মতিন, আবু তাহের, মোহাম্মদ বাশার, খন্দকার আবু জায়েদ জিন্নাহ, ফরহাদ জামিল ফুয়াদ, মোহাম্মদ শামসুল হুদা, ড. নিজাম, জাহের, কচিসহ আরো অনেকে। ঢাকার সন্তান হিসেবে এ শহরের প্রতিটি অলিগলি ছিল আমাদের নখদর্পণে। অন্যদিকে পাকিস্তানি দখলদারদেরও কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল ঢাকায়। তখন পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছিল।
আমরা সংকল্প করলাম ঢাকায় বড় কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের প্রচারণার অসত্যতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবো। ঢাকায় আসার আগে মেজর হায়দার যে ব্রিফিং দিয়েছিলেন তা যুদ্ধকালীন যথাযথভাবে মেনে চলেছি। একক সিদ্ধান্ত না নিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করে অগ্রসর হয়েছি। তাই আমাদের সবগুলো অভিযানই সফলতা পেয়েছিল। গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল মেনে চলেছি, যেমন হিট অ্যান্ড রান, জনগণের মধ্যে থেকে যুদ্ধ করা, শত্রুপক্ষকে সবসময়ই অস্থির রাখা, সাফল্য নিয়ে বেশি উৎফুল্ল না হওয়া, নিজেদের নিরাপত্তার কথা স্মরণে রাখা, যুদ্ধে নিজেরা যতোটা সম্ভব কম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা, প্রমাণাদি একেবারেই সঙ্গে না রাখা, ইত্যাদি। এমন সব জায়গায় আমরা সফল অপারেশন করেছি যে, আজো ভাবলে শরীর শিহরে ওঠে। আমরা অপারেশন টার্গেট নির্ধারণ করতাম প্রচারের গুরুত্ব বিবেচনা করে। যাতে মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পায় এবং শক্রও আতঙ্কগ্রস্ত হয়। প্রতিটি অপারেশনে আমরা আক্রমণ করেই সরে পড়েছি এবং জনগণের মধ্যে থেকে ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া উপভোগ করেছি। অনেক রোমাঞ্চকর অপারেশনের মধ্য থেকে সংক্ষেপে কয়েকটি শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের ঘটনা বর্ণনা করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের কাছে বিমান বাহিনীর একটি রিক্রুটিং অফিস ছিল। এর সামান্য পূর্বদিকে বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি। পরিকল্পনা মতো আমি, লস্কর ও সুফি একটি বেবি টেক্সিতে ব্যাগ ভর্তি ২০ পাউন্ড বিস্ফোরকসহ সেখানে যাই। সিদ্ধান্ত ছিল লস্কর ভেন্টিলেটর দিয়ে বিস্ফোরক যথাস্থানে রেখে আসবে, সুফি ও আমি গাড়িতে বসে কভার দেবো। লস্কর বেচারা ছিলেন আমার মতো খাটো, ভেন্টিলেটরের নাগাল পেতে তার খুব অসুবিধা হচ্ছিল। অবস্থা দেখে সুফি এগিয়ে গিয়ে তাকে সাহায্য করে। আমি ব্যাগের মধ্যে স্টেনগান নিয়ে বেবিটেক্সিতে বসেছিলাম, ড্রাইভার বিষয়টি বুঝতে পেরে বিচলিত হয়ে ওঠে। আমি তাকে ধমক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করি। স্কুটার নিয়ে মেডিকেল কলেজের বর্তমান এমার্জেন্সি গেটে আসতেই বিস্ফোরণের পুরো এলাকা ধোয়া ও ধুলায় অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা ওখানেই বেবিটেক্সি ছেড়ে মেডিকেল কলেজের ভেতরে ঢুকে আবার পশ্চিমদিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে বুয়েটের হলে চলে যাই। সে হলেই থাকতো সঙ্গী লস্কর। ওর রুমে ঢুকে দ্রুত কাপড় বদলে ফিরে যাই ঘটনাস্থলের কাছাকাছি। সেখানে পৌঁছে দেখি হুলুস্থূল অবস্থা। জনতার সঙ্গে মিশে দূর থেকে ঘটনা দেখছি। আশপাশের এলাকা আর্মি, মিলিটারি পুলিশ, বিমান সেনা ও পুলিশ ঘিরে ফেলেছে এবং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। তারা আশঙ্কা করছিল আশপাশে কোথাও মাইন পোতা আছে। এ অপারেশনটি মে মাসের শেষের দিকে অথবা জুনের প্রথমে চালিয়েছিলাম। মাওসেতুং বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন মাছ আর জনগণ জল।’ জল ছাড়া মাছ বাঁচতে পারে না। ঢাকার মানুষ আমাদের মাছের জলের মতোই আশ্রয় দিয়েছিলেন, সহায়তা করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে (নভেম্বর) আমাদের আরেকটি সফল অপারেশন ছিল বিডিয়ারের গেটে। এ অভিযানে অনেক প্রাণহানী হয়েছিল। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড এখানে সে সময় সার্ভের কাজ করছিল। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মজিদ সাহেব ছিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ। এ ঠিকাদার ফার্মটির ইঞ্জিনিয়ার মান্নান এবং ইঞ্জিনিয়ার আনিসুল ইসলাম আমাদের সহায়তা করেন। তাদের সহায়তায় দিনমজুর সেজে পিলখানার অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাই। দিনমজুরদের যে দলটির সঙ্গে আমি ভেতরে যেতাম সে দলের একজন ছাড়া কেউ আমার আসল পরিচয় জানতো না। একদিন কাদামাটি গায়ে ঝিগাতলার গেট দিয়ে বের হচ্ছি এমন সময় মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসপিএর তৎকালীন নেতা মাহবুবুল হক দোলন আমাকে চিনে ফেলেন, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খোকা না? একী হাল?’ আমার তখন ভয় ও বিব্রতকর অবস্থা। সংক্ষেপে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর দ্রুত মিশে গেলাম জনতার মধ্যে। এভাবে বেশ কয়েকদিন পিলখানার অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যাই। আমি উত্তেজনা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পিলখানার অভ্যন্তরের সবকিছু দেখে নিচ্ছি। কোথায় কোথায় অবজার্ভেশন পোস্ট আছে পরখ নেই। যদিও আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল পিলখানার অভ্যন্তরে বিস্ফোরণ ঘটানো। সম্ভব হলে তাদের অস্ত্র ভাণ্ডারের কাছাকাছি। কিন্তু সার্ভের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার ভেতরে বিস্ফোরক নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আজিমপুর কবরস্থান সংলগ্ন গেট এলাকায় আমরা প্রচ- গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন ইপিয়ার বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছিলাম। রাতে পরিচালিত এ হামলার সময় একটি গুলি দেয়ালে লেগে ডিরেকশন চেঞ্জ হয়ে আমার পায়ে এসে লাগে। দুদিন পর একটি ক্লিনিকে গিয়ে ওটা অপারেশন করে তুলতে হয়।
ঢাকায় আমরা আরো অনেক বড় ধরনের অপারেশন করি, ঢাকায় যুদ্ধরত অন্যগ্রুপগুলোও তটস্থ করে তুলেছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা দখলদারদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তবুও পাকিস্তানিদের মিথ্যা প্রচারণায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। তখন সিনেমা হলগুলোয় শো’য়ের আগে ‘চিত্রে পাকিস্তানি খবর’ শিরোনামে ডকুমেন্টরি দেখানো হতো, এতে হানাদাররা প্রমাণ করতে চাইতো যে সব ঠিকঠাক চলছে। ডিএফপিতে মিথ্যাচারে পূর্ণ এ ডকুমেন্টরিগুলো তৈরি হতো। একদিন বায়তুল মোকাররম মার্কেটের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি সেখানে শুটিং হচ্ছে, মার্কেটে কেনাকাটা করছে নারী-পুরুষ, লোক ভাড়া করে এনে এসব চিত্র ধারণ করা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিলাম ডিএফপি উড়িয়ে দেবো। শান্তিনগরের বর্তমানে সেন্সর বোর্ড অফিস সেটিই ছিল ডিএফপি অফিস। ডিএফপির তখনকার চিফ ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে গিয়ে সহযোদ্ধা নান্টু ভাই পুরো অফিসের হাল হকিকত দেখে আসে। এ ভবন কী পরিমাণ বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়া যাবে সে বিষয় পরামর্শ দিলেন সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল আহমেদ সুফির পিতা প্রকৌশলী এস পি আহমেদ। উল্লেখ্য, যখনই আমাদের প্রয়োজন হয়েছে এস পি আহমেদ তার গাড়ি ও টাকা দিয়ে আমাদের সহায়তা করেছেন। তার মালিবাগের বাসা মুক্তিযোদ্ধাদের ঢাকার অলিখিত সদর দপ্তর হয়ে উঠেছিল। সুফির বড় বোন মেজদি আমাদের যেন সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন। আমি, সুফি ও লস্কর ২০ পাউন্ড বিস্ফোরক ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে ডিএফপির দারোয়ানকে বললাম এক সাহেবের কিছু মালামাল এতে আছে। সেদিন অর্ধবেলা অফিস ছিল বিধায় দারোয়ান ছাড়া অন্য কেউ অফিসে ছিল না। রুমের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দারোয়ানকে অস্ত্র দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। তারপর তাকে আসল কথা খুলে বলি, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভবন উড়িয়ে দেবো’। দারোয়ানের পরিবার ওই ভবনেরই তৃতীয় তলায় থাকতো, তাকে স্ত্রী, শিশু সন্তান ও হাঁড়ি-পাতিল সরিয়ে নেয়ার সুযোগ দেই। দারোয়ান জানায়, তার এক ভাইও মুক্তিযোদ্ধা। বোঝাপড়া হয়ে যাওয়ার পর তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বলি, সে যেন শুয়ে থাকে। নিয়ম হলো বিস্ফোরক যতো চাপের মধ্যে থাকবে তার ধ্বংসের ক্ষমতা ততো বাড়বে। সেজন্য টার্গেটকৃত জায়গায় ওটা রেখে দুটি স্টিলের আলমারি দিয়ে চাপা দেই। যাহোক বিস্ফোরণ এতো বিকট হয়েছিল যে, ডিএফপি ভবনের উত্তর দিকের অংশটি উড়ে গিয়েছিল। সেই ভবন সংলগ্ন ১০০ গজের মধ্যে থাকা অন্য বাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ে যায়। অভিযান চালাতে আমরা রিকশায় করে ডিএফপিতে গিয়েছিলাম। দারোয়ান আমাদের তার কাছে থাকা ডিএফপির একটি মাইক্রোবাসের চাবি দেয়, সেটি চালিয়ে দ্রুত কেটে পড়ি। শহীদ মিনার সংলগ্ন মেডিকেলের গেটে গাড়ি রেখে গাঁঢাকা দেই। এ বিস্ফোরণের খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু প্রচার মাধ্যমে বারবার গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে সে খবর। পাকিস্তানিদের মিথ্যা প্রচারণার স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় বিশ্ববাসী। স্থানীয়ভাবে রিক্রুট বিজু এ অভিযানের পুরো সময় আমাদের সঙ্গে ছিল।
সঠিক দিন তারিখ মনে না পড়লেও রোজার মাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন চালিয়েছিলাম তৎকালীন নির্বাচন কমিশন অফিসে। যেসব জাতীয় সংসদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মুক্তাঞ্চলে চলে গিয়েছিলেন তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করে সেগুলোয় উপ-নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছিল কমিশনে। এটি ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টোদিকে মোমেনবাগের দুটি ভাড়া করা বাড়িতে। এর একটি বাড়ির মালিক ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা ড. আব্দুল মঈন খানের বাবা। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা কাশেম (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) বিস্ফোরণ ঘটাতে আমাদের বিশেষ সহায়তা করেন। তিনদিন সে আমাকে ওই অফিসে নিয়ে যায় তার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে। সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখে অপারেশনের পরিকল্পনা করি। অপারেশনের দিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল বলে রাস্তাঘাটে লোক কম ছিল, পরিবেশ অপারেশনের অনুকূলে ছিল। আমি, সুফি, লস্কর, হেদায়েত উল্লাহ, নান্টু ও বাশার এ ৬ সহযোদ্ধা তিনজন করে দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দুই ভবনে বিস্ফোরক স্থাপন করি। এখানেও প্রথমেই অস্ত্র দেখিয়ে দারোয়ানদের আয়ত্তে আনি। দারোয়ানদের কুপোকাত করে তাদের সবাইকে ভবন থেকে সরিয়ে দেই। একজন দারোয়ান চিলেকোঠায় ঘুমিয়ে ছিল। ও কারো নজরে পড়েনি। বিস্ফোরণে একটি ভবনের একাংশ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়, এতে ঘুমিয়ে থাকা দারোয়ানের শরীর ছিন্ন-বিছিন্ন হয় এবং সে মৃত্যুবরণ করে। সফল এ অভিযান শেষে দেখি কাছাকাছি আত্মগোপন করার কোনো জায়গা নেই। তখন আমরা শান্তিবাগের গুলবাগস্থ ওয়াপদা অফিসের কর্মচারীদের একটি মেসে গিয়ে ডাক দেই, তারা দরজা খুলে দিতেই অস্ত্র দেখিয়ে তাদের জিম্মি করে ফেলি। তাদের বলি, ‘কিছুক্ষণ আগে যে বিস্ফোরণ হয়েছে তা আমরা ঘটিয়েছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধা।’ এসব শুনে তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনেছে কিন্তু এতো কাছ থেকে দেখতে পেরে তাদের এ অনুভূতি জন্মে। অপরিচিত মেস মেম্বাররা আমাদের মতো অনাহূত মেহমানদের যথেষ্ট সহায়তা ও খাতির-যত্ন করেন। সাফল্যের উত্তেজনার রাতে ঘুম আসছিল না বলে নিজেদের মধ্যে নানা কথা বলছিলাম। মেসের লোকজন নিষেধ করে বলেন, সামনেই ভূট্টোর পিপলস পার্টির এদেশীয় শীর্ষ নেতা মাওলানা নূরুজ্জামানের বাসা। সে কোনোভাবে জানতে পারলে ভীষণ সমস্যা হবে; সুতরাং সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত হবে। রাতে ঘুমাতে হবে, মেসের সদস্যদের ওপরে সর্বক্ষণিক খেয়াল রাখা সম্ভব নয় ভেবে আমরা তাদের বলি, আমাদের নিয়ম হলো ‘আপনাদের বেঁধে রাখবো, দুজন অস্ত্র উচিয়ে পাহারা দেবে এবং বাকিরা ঘুমাবে। কিন্তু আপনারা যেহেতু সহযোগিতা করছেন, ধরে নিয়েছি আপনারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, সেজন্য আমরা আপনাদের বাঁধলাম না। তবে বাইরে আমাদের আরো লোকজন পাহারা দিচ্ছে, আপনারা কিছু করতে চাইলে সমস্যা হবে।’ আসলে বাইরে আমাদের কেউ ছিল না। তাদের ভয়ের মধ্যে রাখার জন্য এটা বলেছিলাম। মেসের লোকজন ছিল সত্যি ভালো। তারা খুব ভোরে আমাদের নাশতা খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আসার সময় আমাদের অস্ত্র-শস্ত্র লুকিয়ে আনার জন্য ব্যাগ দিয়ে সহযোগিতা করেন।
রাজারবাগ এলাকায় আরেকটি অপারেশনের পরিকল্পনা করি। পুলিশ লাইনের উল্টোদিকের সাধারণ রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যায় অনেক পুলিশ চা নাশতা খেতে আসে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ঠিক সে রকম একটি সময়ে আক্রমণ করে তাদের ধ্বংস করবো এবং সরুপথ দিয়ে মালিবাগের দিকে চলে যাবো। তিন/চারবার চেষ্টা করে একবারো আলাদাভাবে শুধু পুলিশ সদস্যদের পাইনি। অনেক সাধারণ মানুষও ছিল। বিস্ফোরণ ঘটালে এ নীরিহ মানুষগুলো মারা যাবে তাই এই অপারেশন আর চালানো হয়নি। ট্রেনিংয়ের সময় আমাদের মেজর হায়দার নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘অপারেশনের সময় যাতে বাঙালি মারা না যায় তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। টাকা পয়সা ও খাবারের প্রয়োজনে চাঁদাবাজি বা কারো ওপর জুলুম করা যাবে না। প্রয়োজনে সরকারি কোষাগার লুট করবে।’ তবে আমাদের সেসব করতে হয়নি সুফির পিতা ছাড়াও আরো কয়েকজন অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন।
টানটান উত্তেজনার উল্লিখিত অভিযানগুলো ছাড়াও আজম খানের নেতৃত্বে সারুলিয়া অপারেশন ছিল উল্লেখযোগ্য। ডেমরা-সারুলিয়া দিয়ে প্রবেশ করেছে তিতাস গ্যাসের পাইপ লাইন- আজম খান, জিন্নাহ, লাবলু, খুরশিদ, তাহের ও মতিনসহ অনেকে গিয়ে ওখানে এমন ভারী বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল যে, ঢাকা শহরের পূর্বাংশ রাতের অন্ধকারেও দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আলোর তীব্রতা এতো বেশি ছিল যে, রাস্তায় সুইয়ের মতো সরু কিছু পড়ে থাকলেও সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিস্ফোরণ এলাকার মাটি পোড়া ইটের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
আমরা যখন মেলাঘর ক্যাম্পে ট্রেনিং নিচ্ছিলাম তখন আজম খান দেশাত্ববোধকসহ অন্যান্য গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত অক্টোবর মাসের ঘটনা; মাদারটেকের ত্রিমোহিনী বাজারে পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনাটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। বাজারের একদিক থেকে মুক্তিবাহিনী অন্যদিকে পাকবাহিনী অসাবধান অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে যায়। এ অপারেশনে দারুণ সাহস দেখিয়েছিলেন ইসতিয়াক খান লাভলু ও হেলাল (অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের ছোট ভাই)। তাদের তৎপরতার কারণে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরীর ভাই ফতেহ আলী চৌধুরী প্রাণে রক্ষা পান। এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং মুক্তিবাহিনীর শক্ত উপস্থিতি তাদের গোচরীভূত হয়। এ সংঘর্ষের পর পাকবাহিনীর মনে মুক্তিযোদ্ধারা ভয় ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম যে তারা ইচ্ছা করলেই নিরাপদে ঘোরাফিরা করতে পারবে না।
ট্রেনিংয়ের সময়ে আমাদের শক্তভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কোনো প্রমাণাদি সঙ্গে রাখা যাবে না। ডায়রি মেইনটেইন করা যাবে না। অন্যসব নির্দেশের মতোই এসবও আমরা যথাযথভাবে মেনে চলেছি তাই কোনো ঘটনারই দিন তারিখ সঠিকভাবে বলতে পারছি না। যুদ্ধের নয় মাসই আমাদের জীবনে প্রতিদিন এক বা একাধিক ঘটনা ঘটেছে। সেসব বর্ণিল স্মৃতি ফিরে ফিরে মনের আয়নায় ভেসে ওঠে ; স্বল্প পরিসরে সব লেখা সম্ভব নয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের কথা ভাবলেই নস্টালজিক মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মন শুধু রণাঙ্গনের সাহসী সহযোদ্ধাদের হারানোর কারণেই ভারাক্রান্ত হয় না, তার চেয়েও বেশি হয় মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-চেতনার দুর্দশা দেখে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা স্বপ্ন যাই বলি না কেন সেটা শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়, একটি সার্বিক মুক্তিই ছিল এ মহান যুদ্ধের মূল স্প্রিন্ট। সে কারণেই এর নাম হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’। মূলত বৃটিশ বেনিয়াদের রেখে যাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও মানবিক সমাজ গঠনই ছিল স্বপ্ন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এ জাতির একটি সামষ্টিক মুক্তির লক্ষ্য থেকে। তবুও বলবো, জাতীয় মুক্তি না এলেও একটি স্বাধীন দেশ তো আমরা পেয়েছি। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা দেশকে গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারছি, স্বপ্ন দেখতে পারছি সুন্দর আগামীর …..
#ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
আপনার মন্তব্য লিখুন