জীবনের গল্প

ফেলে আসা দিন ও আজ-৫ || পিতাম্বর ধনঞ্জয় ঘোষাল

জীবন যখন শুরু হয়েছিল তখন এমন সব ঘটনা ঘটেছিল যা এ জীবনে ভোলার নয়। যেমন সেই দিদি ভাই !একদিন পৌষের রাত্রে আমার জীবনের চরমতম যে চরম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতে চলেছিল ,সেই রাত্রে আমি আমি অক্ষত থাকতে পেরে ছিলাম। তার কারন আমি তখনও পর্যন্ত
সাবালকত্ব প্রাপ্ত হই নি।এই রকম বহু ঘটনা যা প্রত্যেকের জীবনে কখনো না কখনো ঘটেছে।কেউ ব্যক্ত করতে পারে কেউ পারেনা ।

আমার এই ফেসবুক বা হোয়াটস অ্যাপ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি আমার বাড়ির সকলে খুব অপছন্দ করে।আড়ালে আবডালে ফিসফিস গিজগিজ করে। এমন কী সন্দেহও করে। শুধু বাড়ীই বা কেন ? যারা একটু মক্ষিচুষ্ তদেরও চোখ টাটায়!কেন টাটায় ? নেট তো আর বিনে পয়সায় চলেনা। শালার অনেক মাল আছে।

যারা কোনদিন খবর রাখেনা -কেমন আছি বা আমার কোন দৈনন্দিন জীবনের কিছু প্রয়োজন আছে কিনা তারাও সমালোচনা করতে ছাড়ে না। কেউ তো জীজ্ঞেস পর্যন্ত
করে না -তুমি কেমন আছ? তুমি ভালো আছো তো? তোমার কি কিছু প্রয়োজন আছে? না। কেউ বলে না। কেউ না ।
যাদের জন্য পুরো জীবন উৎসর্গ করলাম , কোন রকম মধ্যযুগিয় প্রথা না মেনে শুধু মাত্র বিবেক এবং আদর্শের উপর ভিত্তি করে স্থান দিলাম –তারাই দেখলাম সবচাইতে হিংস্র কুটিল এবং সদা সর্বদা ব্যস্ত কী করে আমাকে সংসার থেকে আলাদা করা যায় ! আসলে জীবনে যারা কোনদিন কোন স্বচ্ছলতার মুখ দেখেনি তারা কেমন উন্মাদ হয়ে যায় । যাক্ গে । যে যার মতো থাকুক,তাতে আমার কি আসে যায় ? যে মেয়েটি তার প্রাইভেট মাস্টারের দ্বারা গর্ভবতী হলো ! সে তো আমারই স্মরণাপন্ন হলো তাও আবার মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে । অর্থ সাহয্য । আমি না বুঝেই তাকে সাহয্য করলাম এবং ফল স্বরূপ কলঙ্কটি আমায় বহন করতে হলো। অথচ আমি তখন সেখান থেকে তিনশো কিলোমিটার দূরে থাকতাম।

ট্রেন চলছে। আমি জানালার ধারে বসে বাইরে তাকিয়ে আছি। সর সর করে গাছ ,বাড়ী ঘর পিছিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের ভেতরে চা-ওয়ালা,ঝালমুড়ি ওয়ালাদের সুর করে করে বিক্রিকরে চলেছে। আমি এই প্রথম জীবিকার সন্ধানে চলেছি অচেনা অজানা এক জায়গায়। কোন নিশ্চয়তা নেই। যার কথায় আমার চাকরির সন্ধানে যাওয়া তাকে আমি খুব একটা চিনতাম না।বরং একটু খটকা ছিলো। এক কথায় বলে দিল চাষনালা গেলেই চাকরি হয়ে যাবে ।কি চাকরি ? কেমন করে হবে ? কোথায় গিয়ে উঠবো ? এসব আমি জানতাম না।
আর তখন আমার এমন মনের অবস্থা যে ওসব নিয়ে ভাববার সময়ই পাইনি। আমার একুশ বছরের জীবনে হাজার হাজার বছর ধরে দেখে চলেছি বঞ্চনার-উপেক্ষার-শোষণের ধারাবাহিকতা। আমার আমিত্বকে রক্ষা করার তাগিদে আমাকে যে কোন ঝুঁকি নিতে হবে।

ট্রেনের দুলুনিতে আমার সারা শরীর দুলছে। কতো কথাই যে মনে ভিড় করে আসছে ! ছোট্টোবেলার দুরন্তপনা। পড়ন্ত নদীর বানে পাড় থেকে লাফ দিয়ে সাঁতার কাটা। বড় বড় গাছের মগ ডালে উঠে কোটর থেকে টিয়া পাখির বাচ্চা পেড়ে আনা। একবার তো শেয়ালের বাচ্চা ধরে এনেছিলাম। মায়ের কি বকুনি ! অনিচ্ছা সত্বেও শেয়াল বাচ্চাটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। সে দুঃখ আমি আজও ভুলতে পারিনি ।

ওই যে বার বার দিদি ভাইয়ের কথা বলছি –সেটা তো খুব সম্মানের কথা নয়। তবুও মিঠুলকে বলেছিলাম -যে আমি যা লিখবো সব সত্য বলবো ।
আমি ভাব ছিলাম ! মনের সাথে কথা বলছিলাম —
বুলুদি তোমার সাথে দেখা হলো না এ জীবনে আর হবেও না কোনদিন। দেখা
হলে একবার জীজ্ঞেস করতাম তোমাকে-
তোমার ভরা যৌবনে একটি সতের বছরের টিন এজারকে কেন বেছে নিলে?
তুমি এতদিনে বুড়ি হয়ে গেছো নিশ্চয়।

বোধ করি সব ভুলেও গেছ এতদিনে !
কিন্তু আমি যে ভুলিনি দিদিভাই । তুমি একটি আস্ত কালনাগিনী ,তোমাকে বলাই হলো না তুমি একটি বারবধূ অপেক্ষাও ঘৃণ্য । দিদি ভাই এই বৃদ্ধাবস্থায় তেমনি আছো ? তোমার বিবাহ বিহীন লোকটি যাকে তুমি স্বামী বলে পরিচয় দাও সে ভালো আছে তো ?
না কি সে এতদিনে অন্য কোন বুলুর কোলে মাথা রেখেছে ? ন কি তুমিই চুনরি পাল্টে ফেলেছ ? লাগা চুনরি মে দাগ ।
হো গয়ি ময়লি মোহে চুনরিয়া । আমার সতেরো বছরের হৃদয়ে যে ক্ষত করেছ তুমি ও তোমার প্রেমিক হাজরা মশাই –
তা আমি কি করে ভুলি বলতো দিদিভাই?

ট্রেন ছুটে চলেছে আপন গতিতে কত স্টেশন পেরিয়ে গেল –ছাতনা,ঝাটিপাহাড়ি , ইন্দ্রবিল সিরাজম
সব কেমন সর সর করে পেরিয়ে যাচ্ছে
আর আমার মনেও সর সর করে স্মৃতি গুলো বেরিয়ে আসছে । আমার দু চোখ জলে ভরে যাচ্ছে । মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে । এই একুশ বছর বয়স পর্যন্ত কখনো মাকে ছেড়ে থাকিনি। মা ছাড়া ঘুম হয়না। কি করে যে থাকবো ? কতদিন মা না খেয়ে বসে থেকেছে আমার জন্যে । আমি বাড়ী ফিরিনি বলে। আমার জন্য মা যে কত অশান্তি ভোগ করেছে ! আজ চোখের জল বাঁধ মানছে না ।
ট্রেন এসে থামল আদ্রা স্টেশনে। আদ্রা জংশন স্টেশন এখানে দশ মিনিট দাঁড়ায়। আমি খুব ভোরে বেরিয়ে ছিলাম তাই আমার খিদেও পেয়েছিল। আমি পাশের যাত্রীকে বলে ট্রেন থেকে নামলাম একটু কিছু খাবার জন্যে। আদ্রা স্টেশনে খুব ভালো কেক পাওয়া যায় শুনেছিলাম । একটা স্টলে গিয়ে একটা টিফিন কেক নিলাম।এবং দ্রুত কেকটা শেষ করে চা খেতে হবে । সময় তো মাত্র দশ মিনিট। চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত কামরার সামনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
ট্রেনের হুইসেল বাজার পর ট্রেনে উঠলাম । ট্রেন চলেছে আপন গতিতে। তখন কয়লার ইঞ্জিনে ট্রেন চলত। আর চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া গল গল করে বেরি পেছনের দিকে উড়ত। জানলার ধারে মাঝে মাঝে কয়লার গুঁড়ো চোখে পড়ত। আমারও পড়ল। পাশের দিদি বললে –চোখ ঘসলে আরো জ্বালা করবে ! উনি ফুঁ দিয়ে খানিকটা অস্বস্তি কাটিয়ে দিলেন।
হঠাৎ দেখি পাশের দিদি নামছেন। আমি নিজে থেকেই ওনার বড় বড় সাইজের ব্যাগ গুলো নামাতে সাহায্য করলাম । স্টেশনের নাম ভজুডি ! এরপরই আমার নামার পালা।মাঝে দামোদর নদ এপাশে ভজুডি ওপারে সুদামডি । ওখানেই আমাকে নামতে হবে অজানা অচেনা বিহারের এক খনি অঞ্চলে । যেখানে হিন্দি ভাষীর সংখ্যা বেশি ।

অবশেষে আমি সুদামডি স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। আমি আমার একমাত্র ব্যাগ নিয়ে নামলাম । চারি দিকে কয়লা আর কয়লা। চারপাশ কালো । রাস্তা কালো ,গাছ গুলোও কালো কালো । সুদামডি খুবই ছোট্ট স্টেশন । দেখলাম যারা নামলো তারা প্রায় সকলেই স্টেশনের বাঁ দিক দিয়ে ঢালু রাস্তা দিয়ে খুব দ্রুত সব প্রায় দৌড়ে দৌড়ে ছুটে চলেছে! আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম । কারন যার কথায় আমার এই অভিযান সে বলেছিলো –” সুদামডি স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে গড়গঁড়াই পড়ে গেলেই চাষনালা চলে যাবে হে ” ।
ভদ্রলোকের বাড়ী বিহারেঅধুনা ঝারখণ্ড, কিন্তু বাঙালি। কিন্তু কথা বার্তার মধ্যে কেমন একটা মানভূমের টান –বেশ বোঝা যায় ।
যাই হোক আমি ডান দিকে ঢালু নামাল রাস্তা দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই গড়গড়িয়ে গেলাম। বাপ্ রে কতো কয়লা । চারদিকে শুধু কয়লা আর কয়লা । অতো কয়লা আমি জীবনে দেখিনি । যে ঢলান দিয়ে রাস্তা নামক জায়গায় নামলাম সেখানে শুধুই কয়লার গুঁড়ো । ঘন ঘন ডাম্পার হয় কয়লা নিয়ে আসছে নয় খালি গাড়ি কয়লা নিতে যাচ্ছে। আমি ভাবছিলাম এতো কয়লা যাচ্ছে কোথায়?

কোথাও কোন লোক দেখছি না যাকে জীজ্ঞেস করা যায় -মিসির বাবুর কোয়াটার কোনদিকে ? হঠাৎ দেখি একটা লোক খাকি হাফ প্যান্ট আর শার্ট পরে আমার পিছু পিছু আসছে । আমি পিছন ফিরে জীজ্ঞেস করলাম –এ ভাই আপ মিসির বাবু কো জানতে হেঁ ? লোকটা দেহাতী বাংলায় বলে— হঁ চিনি ।
তুমি কুথা যাবি ন “। আমি বললাম –আমি মিশ্রবাবুর বাড়ী যাবো। তুমি জানো ? লোকটি বিস্মিত হয়ে বলে —- হাঁই দেখ জাইনবনা ?উয়ার কটরেই তো কাজ করি। চল বাবু তুমাকে লিয়ে যাবো। আমি বললাম কতো দূর ? সে বলল —-দুর কুথা পেলি হুঁ দেখ্ । কথায় কথায় জানলাম ওর নাম মথুরা মাহাতো।

মিনিট দশেকের মধ্যে আমি মিশ্র বাবুর কোয়াটারে পৌঁছলাম। তখন বেলা সাড়ে বারোটা বাজে। মথুরা গেট খুলে ঢুকে বললে —-বাবু দাঁড়াও ! আমি বাবুকে শুধাঁই আসি।আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বাইরে। মিনিট দশেক পর আমার সেই কাংখিত মিশ্র বাবুর বাজখাঁই গলা শুনতে পেলাম। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম মিশ্র বাবু হেঁড়ে গলায় মথুরাকে বকে চলেছে–কে?
কে এসেছে ? যখন তখন কেউ এলেই আমার বাসায় নিয়ে আসবি ?তোকে আর দরকার নেই–চাকরি করার দরকার নেই । মথুরা হয়তো আমার দুর্দশার কথা কিছুটা আন্দাজ করেছিল সে মিন মিন করে বলে –উটো লোক লয়,একটো ছিলা বেটে। হঠাৎ দরজা খুলে মহামান্য মিশ্র বাবু খালি গায়ে -পরনে গামছা আর কাঁধে এক গাছা পৈতে । আস্ত একটা জাম্বোবান। বেজায়
কালো,মস্ত ভুঁড়ি আর অত্যন্ত কর্কশ কণ্ঠ। আমি অবাক হয়ে গেলাম যখন মিশ্র বাবু বাজখাঁই গলায় জীজ্ঞেস করলেন-কাকে চাই, কি চাই ? এখানে কি ? মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টা আগে যে আমাকে বলে ছিল চাষনালা গেলেই চাকরি। সে হঠাৎ একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে বলে কিনা কি চাই ?কে তুমি ? দুপুর বেলায় চলে এসেছে ! আমার তখন মনে হচ্ছিল পৃথিবী দ্বিধা হও-আমি কি যে বলি ?
নিথর নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এই লোকটাকে আমি কি উত্তর দেব !এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে নারী কণ্ঠে কেউ ফিসফিস করে কিছু বলল। তখন সেই বাজখাঁই কণ্ঠের অধিকারী শ্রী যুক্ত মিশ্র মহোদয় হাঁক দিলেন–মথুর ! যা একে নিয়ে জুনিয়র হস্টেলে ধীরু কাকার কাছে পৌঁছে দিয়ে আয় । বলেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি হতবাক।এরকমও হয় ? মাত্র দুদিন আগে যে বললে এখানে এলেই চাকরি! আর আসার পর ভিখিরি বিদায়।

যার কাছে পাঠালে সে আমাদের একটু
দূরের আত্মীয়। তো মথুর আমাকে ওই
জুনিয়র হস্টেলে পৌঁছে দিয়ে গেল । মস্ত বড় একটা বাড়ী।টানা লম্বা বারান্দা। আর একটা সাইডে পর পর রূম ।মাঝে একটা মস্তবড় ডাইনিং হল । দু দিকের দু প্রান্তে পর পর বাথ রুম।ওটা ছিলো ইস্কোর কর্মীদের হস্টেল । ইস্কো বলেতো
ইন্ডিয়ান আয়রন স্টিল করপোরশেন ! শর্টে IISCO. ইস্কোর মালিক ছিলেন স্যার বীরেন মুখার্জী । যিনি হাওড়া ব্রীজ বানিয়ে স্যার উপাধি পান । যাই হোক ১৯৭২ সালে একত্রিশে ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কয়লাকে জাতীয় করন করেন ফলে ইস্কো আন্ডার টেকেন হয়ে যায় । অর্থাৎ সরকারি হয়ে যায় ।

এখান থেকেই আমার চাষনালা এবং চাকরি জীবন শুরু। আর এখানেই আছে আমার নানান ঘটনা, দুঃখ আর বেদনার ইতিহাস।

চলবে——>

পশ্চিমবঙ্গ,ভারত