রঙের জীবন

অচেনা দাদু || এম এম এইচ হিলকিং

শ্যামল বাংলার মায়াবী আঁচলে বয়ে চলা নদীর
তীরে বসে অচেনা সেই বৃদ্ধ দাদু নিশ্চয় আমার
জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন বিকেল বেলা
দুজন একসাথে বসে কথা বলাটা অভ্যাসে পরিণত
হয়েছে। আজ একটু দেরি করে ফেললাম। তাই
দ্রুত হাটছি আর ভাবছি, অচেনা দাদু চলে গেল না
তো আবার। দূর থেকে দেখতে পেলাম, দাদু
করুণ দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে কি যেন
ভাবছে। কাছে গিয়ে মনে হল, দাদুর মন আজ খুব
খারাপ।
কাঁধে হাত রেখে বললাম, কি হয়েছে দাদু তোমার?
চশমা খুলে চোখ মুছে বলল, না রে কিছু না। একটু
ভাবনায় হারায়ে গেছিলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম, অচেনা দাদুর মনে অনেক কষ্ট জমে আছে। কিন্তু কাউকে তা বুঝতেই দেয় না। দাদুর জীবনের আনন্দঘন অসংখ্য অতীতের গল্প শুনেছি তার মুখেই। বর্তমানে
কিভাবে জীবন কাটাচ্ছেন, তা কখনো শোনাই
হয়নি।

আজ খুব করে ধরলাম দাদুকে তার বর্তমান জীবনকে নিয়ে কিছু বলার জন্য। “আজ আর না।
অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাল তোকে সব বলব।” এই বলে উঠে চলে গেলো। আমিও আর দেরি করলাম না।
অচেনা দাদুর সাথে নদীর পাড়েই পরিচয় হয়েছিল।
অনেক বয়স হয়ে গেছে দাদুর। শরীর খুবই দূর্বল, ভাল ভাবে হাঁটতে পারে না। চশমা ছাড়া
চোখেও ভাল দেখেন না। তবুও আসেন, লাজ-
নম্র পল্লীবধূর মতো ছন্দ তুলে এঁকেবেঁকে চলা নদীর তীরে। এ নদীই যেন তার মনের তৃষ্ণা মেটায়।
পরের দিন অতি আগ্রহ নিয়ে গেলাম, নদীর সেই
নির্দিষ্ট জায়গায়, যেখানে আমরা প্রতিদিন দেখা করি,
কথা বলি। অনেক অপেক্ষার পর দাদু এসে হাজির।
দাদুকে খুব অসুস্থ লাগছিল, আর মনটাও যেন ভাল
নেই। বললাম, আজ তো তুমিই দেরি করলে। আজ
কেমন জানি লাগছে তোমায়! দাদু আমার কথার উত্তর না দিয়ে, বসে জর্জরিত কণ্ঠে বলতে শুরু করল তার বর্তমান অবস্থার কথা।
” আমি এখন খুব অসহায় হয়ে পরেছি। দেখেই
তো বুঝতে পারছিস, কোনো কাজ করার ক্ষমতা
নেই আমার। যখন ক্ষমতা ছিল, তখন মাথার ঘাম পায়ে
ফেলে ছেলেদের পড়াশুনা করিয়েছি, বড় করেছি। কখনো তাদের বিন্দু পরিমাণ কষ্ট করতে
দেই নি। নিজে না খেয়ে হলেও তাদের মুখে
খাবার তুলে দিয়েছি। ছোট বেলা থেকে তাদের
সব কাপড় আমিই ধুয়েছি। মায়ের অভাব কখনো
বুঝতে দেই নি। নিজের জমানো সব টাকা দিয়ে
তাদের বিয়েও দিয়েছি। যতদিন আমার শরীরে
শক্তি ছিল, ততদিন সবকিছু ভালই চলছিল। কিন্তু এখন আমি তাদের বোঝা হয়ে গেছি। যারা
আমায় কথায় কথায় জড়িয়ে ধরতো, তারা এখন আমার
কাছে আসতেই ঘৃণা করে। আমার গা দিয়ে দূর্গন্ধ
বের হয়। বাড়িতে আমাকে নিয়ে ভাগাভাগি শুরু হয়ে
গেছে। সারাদিন বউমাদের কথা শুনতে শুনতে
অধৈর্য হয়ে পরেছি। এত কথা শোনানোর পর যে
খাবারটুকু দেয় তাও গলা দিয়ে নামতে চায় না। নিজের
বাড়িতে কুকুরের মত থাকতে হয় আমাকে। রাতেও
শান্তি করে ঘুমাতে পারি না মশার জ্বালায়। চা-পান খাওয়াও নিষেধ আমার। পাঞ্জাবিতে দাগ লাগলে নিজেকেই ধুতে হবে, বলে দিয়েছি। ছেলেদের বিয়ের
পর থেকে আমার জীবনে নেমে এসেছে কালবৈশাখীর ঝড়। যা থামতেই চাইছে না। তবুও
মনকে একটু সান্ত্বনা দিতে, একটু শান্তি উপলব্ধি
করতে চলে আসি নদীর তীরে। তুই না থাকলে
হয়তো এই শান্তি টুকুও পেতাম না। শ্যামল- কাজল
নদীর সাথে তোকে পেয়ে শাশ্বত অনুভূতিতে
হৃদয় ভরে ওঠে।
কিন্তু কয়েকদিন থেকে মন যেন কথাই শুনছে না।
এক নতুন ঝড়ের প্রলয় তান্ডব, ভয়ংকর রুপ নিয়ে সব
কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছি। শুনছি,,, ওরা আমায় বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। আমি নাকি ওদের বোঝা হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছি,
কোনো কাজে আসি না, অযথা শুধু জ্বালাতন করি।
তাই বৃদ্ধাশ্রমেই আমাকে রেখে আসবে ওরা।
আমিও বলে দিয়েছি, জীবন থাকতে আমি আমার
বাপের ভিটা, আমার জন্মস্থান, আমার বাসস্থান ছেড়ে
কোথাও যাব না। যতই কষ্ট দাও না কেন, মরতে হয়
এখানেই মরব। এই অপরাধে কাল থেকে বউমারা
আমায় উপবাস রেখেছে। শরীরটা আর চলতেই চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন ধরণী থেকে বিদায় নেয়ার সময় এসেছে। বিচিত্র সৌন্দর্যের এই
লীলাভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে বহুদূর। মৃত্যু
যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়।” দাদুর চোখ থেকে অবিরাম ধারায় বেদনার বৃষ্টি
ঝড়তে দেখে, নিজেকে আর সামলাতে পারলাম
না। আমার চোখে এতক্ষণ নদীর ঢেউয়ের মত
টলোমলো করা জল, উপচিয়ে পরতে শুরু করল।
দাদুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,’আমার
নিজের দাদুকে কখনো দেখিনি। তুমিই আমার
নিজের দাদুর মত। তোমাকে আমি হারাতে চাই না। তুমি
কোথাও যাবে না। আমার সাথে চলো। তোমাকে
আর কষ্ট করতে দিব না আমি।” দাদুকে জোর করে নিয়ে গেলাম আমাদের বাড়িতে। নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিয়ে, খেতে
দিলাম। মনে হল, অনেক দিন পর দাদু পেট ভরে,
শান্তি করে খেলো। সন্ধ্যায় চা-নাস্তা করে দাদু বলল, ‘এখন আমাকে যেতে হবে। না বলিস না। তোর উপর আমি অনেক
খুশি। একটা কথা মনে রাখবি, অপরের উপকার করেই
মানবজীবন ধন্য ও সার্থক হয়। দোয়া করি, তুই
অনেক বড় হবি, মানব কল্যানে নিঃস্বার্থভাবে কাজ
করবি। ভাল থাকিস আর মা বাবার খেয়াল রাখবি।’
“কাল বিকেলে নদীর তীরে তোমার জন্য অপেক্ষা করব কিন্তু”। দাদু মুচকি হেসে চশমা ঠিক
করে বলল,”আচ্ছা,আসবো!”
দাদুর সাথে আমাদের পাশের বাড়ির বক্কর ভাইয়াকে
পাঠালাম, বাড়ি পৌছে দেয়ার জন্য। অচেনা দাদুর কথাগুলো কানে বাজছিল। সেদিন
ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে
দেখি প্রচন্ড জ্বর শরীরে। বালিশ থেকে মাথা
তুলতে পারছিলাম না। ….. দাদুর সাথে দেখা করার জন্যে বিকেলে অনেক চেষ্টা করে উঠে গোসল করে নদীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
নদীর তীরে দাদুকে না দেখতে পেয়ে নির্জনে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মনের
ভেতর নানা রকম ভাবনা ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। সেই
অনুভূতির কোনো স্পষ্ট রুপ নেই, নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই। সন্ধ্যা নেমে এলো, কিন্তু
দাদুর কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম না। মনটা
উতলা হয়ে উঠলো দাদুকে দেখার জন্য। অসুস্থ
শরীর নিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরে এলাম।

পরের দিন একই সময়, একই জায়গায় বসে আবারো
অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলাম। কিন্তু দাদু এলো
না। বুকের ভেতর করুণ বাশির সুর বেজে উঠল।
আর সেই সুর যেন চৌচির করে দিচ্ছিল আমাকে।
এভাবে আরও দুই দিন চলে গেলো। কিন্তু দাদুর
দেখা মিললো না।
আর অপেক্ষা নয়। এবার বক্কর ভাইকে নিয়ে দাদুর
বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মেঘের গুরুগুরু গর্জন, গাছের ডালে বাতাসের
ঝাপটা, হঠাৎ বাজ পড়ার প্রচন্ড শব্দ। বাস্তায় জনমানব
নেই। তবুও দাদুর বাড়িতে বৃষ্টিতে ভিজেই পৌছালাম।
সেখানে গিয়ে বোঝার আর কিছু বাকি রইল না।
দাদুকে রেখে আসা হয়েছে রাস্তার পাশে,
অন্ধকার কবরে। দেখলাম, কবরের উপর খেজুর
গাছের ডাল এখানো সজীব, আর বৃষ্টির ছোয়ায় তা
দুলছে। চারিদিকে পানি জমে গেছে। এমন
অবস্থায়, দাদুর পাশে কেউ নেই। কাছে গিয়ে হাঁটু
গেড়ে বসে, কল্পনার রাজ্যে দাদুকে খুজে
পেলাম।
সন্ধ্যার আগমুহূর্তের সেই ঝুমঝুম বৃষ্টি, আমার
চোখের জলকে সঙ্গী করে মাটিতে মিশে
যেতে লাগলো।

কুড়িগ্রাম